স্বাধীনতা যুদ্ধে বাকেরগঞ্জের ইতিহাস হাজার বছরের স্বাধীকারের ইতিহাস।যুগে যুগে লাখো লাখো শোষিত, নীপিড়িত, স্বাধীনচেতা মানুষের রক্তের বিনিময়ে গড়া রক্ত ঝরা ইতিহাস।এই বাকেরগঞ্জ প্রকৃতির অকৃপণদানে ধন্য সবুজ শ্যামলে ভরপুর।প্রাচীনকাল হতে স্বাধীনচেতা জমিদারের স্মৃতির চারণভূমি, প্রাগৈতিহাসিক সুপ্রাচীন এই জনপদ বাকেরগঞ্জ।শায়েস্তা খাঁ এবং তার পুত্র বুজর্গ উমেদ খানের আবাস ভূমি, বার আউলিয়াদের পূন্য ভূমি।বাকেরগঞ্জে ইংরেজ, পর্তুগীজ ও ফরাসি বেনিয়া গোষ্ঠী বাণিজ্যিক কেন্দ্র করে উপমহাদেশে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল।তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে স্বাধীকার আদায়ের দাবীতে জনাব আইনউদ্দিন সিকদার এবং নলচিড়ার ইমামউদ্দিন, নিয়ামতি ইউনিয়নের বারসামানের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে পলাশী থেকে আগত একদল সৈন্য এ অঞ্চলের জনগণকে নিয়ে শরিকলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরাজিত ও নিহত হন।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চের ভাষনে সাড়া দিয়ে রংগশ্রী ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গো-হাট ময়দানে স্থানীয় আনসার কমান্ডার ও তার কয়েকজন সহযোগীদের নেতৃত্বে বাহাদুরপুর সমাজকল্যান ক্লাবের ৫০/৬০জন সদস্য বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে ১২ মার্চ নিজেদের আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সর্বপ্রথম ট্রেনিং করে।৭ মার্চ ভাষনের পরের দিন বোয়ালিয়া বাজারে কালাচাদ দাসের দোকানের সামনে মুক্তিকামী জনতা পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে ফেলে।২২ মার্চ থেকে বাহাদুরপুর ক্লাবের সামনে নিয়মিত বাংলাদেশী পতাকা উত্তোলন করা হয়, যা উড়তে দেখেছেন অনেকেই ।ইতিমধ্যে বরিশার জেলা আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ একটি মুক্তিযোদ্ধা সহায়তা কমিটি গঠন করে পাঠানোর নির্দেশ দেন।সে অনুযায়ী ১৪টি ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা সহায়তা কমিটি এবং থানা কমিটি গঠন করা হয় ।উক্ত থানা কমিটি ৬৯ এর ছাত্র সংগ্রাম কমিটিকে সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত করে বিস্তারিত তথ্যাবলীসহ বরিশাল সদর গার্লস স্কুলের ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়।দীর্ঘ এক মাস যাবৎ হানাদার বাহিনী বরিশাল অঞ্চলে ঢোকার চেষ্টা করেও বাকেরগঞ্জের সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিঘাতে প্রবেশ করতে পারেনি।ইতোমধ্যে প্রভুদের গন্ধ পেয়ে আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধচক্র গোপনে মুক্তিকামী সংগ্রামী দামাল ছেলেদের তালিকা প্রস্তত করে।অন্যদিকে বাকেরগঞ্জের এম,এন,এ জনাব মুজিবুর রহমান মোল্লার বাড়িতে কয়েকদিন মুক্তিবাহিনীরা হানা দেয়।এইজন্য যে, তিনি যাতে বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করেন।একদিন তিনি স্বেচ্ছায় কালো ব্যাচ ধারণ ও স্বাধীন বাংলার পতাকা খয়রাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সামনে উত্তোলন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে “জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু” শ্লোগান দেয়।এর পর তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, আমরা বাংগালী বাংলাদেশকে ভালবাসি, তাই বাংলার স্বার্থে আমি তোমাদের সাথে একাত্ত্বতা ঘোষনা করলাম।এমনি করে মুসলিমলীগ, পি ডি পি,জামায়াত ইসলামী, নেজাম ইসলামী দলের লোকেরা বিভিন্ন সময়,পাক হানাদার বাহিণী অত্র এলাকায় আসার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত ওয়াদা করে আসছিল।তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামীলীগের সদস্য জনাব মোজাম্মেল হোসেন সিকদার, ছাত্র নেতা খান আলতাফ হোসেন ভুলু, জনাব শওকত হোসেন ও অন্যান্য নেতৃস্থানীয় আওয়ামীলীগ কর্মীদের আহ্বানে খয়রাবাদ হাইস্কুলের কক্ষে গোপন একটি মিটিং করা হয় ।ঐ সময় পাদ্রীশিবপুরের ট্রেনিং এর কথা বলা হয় যে, তোমরা ট্রেনিং এ যাবে এবং ঐ দিনই ট্রেনিং এর সময় পাদ্রীশিবপুরের ট্রেনিং ক্যাম্পটি ধংস করে দেবে এবং এই দায়িত্ব দেয়া হয় বাহাদুরপুরের মুজিবুর রহমানকে ।কিন্তু তিনি উক্ত প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন ।
ইতোমধ্যে পাক হানাদার বাহিনী ২৬ এপ্রিল ঝুনাহার থেকে কামান ছুড়তে ছুড়তে বরিশালে প্রবেশ করে ।এরপর একটা হেলিকপ্টার ও জঙ্গী বিমানের সহায়তায় বিনা বাধায় বরিশাল শহর দখল করে নেয় ।পাক হানাদার বাহিনী আসার সাথে সাথে এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় অত্যাচার চালাতে থাকে, হত্যা করে অসংখ্য মানুষ, আহত হয় অনেকে ।তখন বরিশাল শহর জনশূন্য হয়ে পড়ে ।২৬ এপ্রিলে বরিশালে পাকহানাদার বাহিনী ঢোকার কিছু সময় পরেই ইতিহাসের পাতা থেকে খুঁজে বের করে বাকেরগঞ্জের পথ । ৩টি গানবোটসহ বিকাল ৫ টায় বাকেরগঞ্জ বন্দরে এসে পৌছে ।বেপরোয়া কামান ও সেলিংয়ের শব্দে বাকেরগঞ্জ বন্দরের রোকজন বাড়ী ঘর যাবতীয় সবকিছু ছেড়ে জীবনের ভয়ে নারী পুরুষ,আবাল,বৃদ্ধ সবাই ৮/১০ মাইল দূরে গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়, সমস্ত রাত দিন হাজার হাজার কামান সেলিং এর শব্দে বাকেরগঞ্জে আকাশ, বাতাস, মাটি, পানি, মানুষ থর থর করে কাপতে থাকে ।৭১ এর ০৯ মাস বাকেরগঞ্জের প্রত্যেকটি মানুষের আলাদা একটি ইতিহাস আছে ।নিরীহ মানুষদের হত্যা, অবিচার, অত্যাচার, নারী নির্যাতন, লুন্ঠন,রাহাজানি, অবিরাম ধারায় শুরু হয়েছিল।পশ্চিমাদের পা চাটা মীরজাফরের দল ও পাক হানাদার বাহিনীর ধ্বংস লীলা প্রতিরোধ করার জন্য ক্যাপ্টেন নাসিরউদ্দিন এর নেতৃত্বে একটি বাহীনী এবং পরবর্তিতে ছাত্রনেতা রফিকুল ইসলাম জাফরের নেতৃত্বে একটি বাহিনী গড়ে উঠে ।ক) ক্যাপ্টেন নাসিরউদ্দিনের অধীনে রংগশ্রী, ভরপাশা, পাদ্রীশিবপুর, নিয়ামতি অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় খ) রফিকুল ইসলাম জাফরের বাহিনী গারুড়িয়া, কলসকাঠী, চরাদী ও চরামদ্দি এলাকা নিয়ে গঠিত হয় গ) জনাব পঞ্চম আলীর নেতৃত্বে দুর্গাপাশা, ফরিদপুর, কবাই এলাকা নিয়ে গঠিত হয় এবং এই বাহিনী বাউফল এলাকায়ও তৎপরতা চালায় ।অত্র এলাকায় অনেক অত্যাচার অবিচার এর মধ্যে সরাসরি পাক হানাদারা বাহিনী হামলা চালায়। (১) দুধল (২) কলসকাঠী (৩) শ্যামপুর (৪) নন্দপাড়া (৫) কুসাংগল , বোয়ালিয়া (৬) খয়রাবাদ ও গারুড়িয়াসহ অনেক স্থানেই নির্বিচারে হামলা চালায় ।
উল্লেখিত বাহিনীতে অত্র এলাকার যুবক, ছাত্র,আনসার, ই পি আর, পুলিশ, সেনাবাহিনীর লোকজন সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন ।অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে এদেশীয় দালালদের সহযোগিতায় দেশদ্রোহিতার জন্য মামলা দায়ের করা হয় ।বাকেরগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকার মুক্তিকামী জনতা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায় এবং দেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবনকে বাজি রেখে হাসতে হাসতে দলে দলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে থাকে ।
পাশাপাশি পাক হানাদার বাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য দেশীয় দোসরদের সহায়তায় গরীব লোকদের লোভ লালসা দেখিয়ে চাকুরীর কথা বলে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ইসলামী শব্দের সাথে সংগতি রেখে সৃষ্টি করে বিভিন্ন বাহিনী ।অপর দিকে পাক হানাদার বাহিনী দেশীয় দোসরদের মদদপুষ্ট হয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় । গুলি করে আগুনে পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে অসংখ্য মানুষ।
বাকেরগঞ্জ থানায় পাক হানাদার বাহিনী স্থায়ীভাবে ঘাটি করে তাদের বর্বরতার অধ্যায় শুরু করে ।২৭ এপ্রিল বিকেপি হাইস্কুল এলাকায় ও উত্তর দাড়িয়াল বারইপাড়ায় তারা ব্যাপক লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং চার জনকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং ১৩ই মে নন্দপাড়া, কুসংগল ও বোয়ালিয়া এলাকায় ৫ জন নিরপরাধ বাংগালিকে হত্যা করে ।যার মধ্যে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব রাধেরশ্যাম মাষ্টার ছিলেন ।৫ জুন দেশীয় দোসরদের সহায়তায় পাক হানাদার বাহিনী খয়রাবাদ ও গারুড়িয়া বাজার এলাকায় এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় ।অত্র এলাকার এক প্রবীন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোক সর্বজন নন্দিত জনাব মানিক লাল চক্রবর্তীসহ ঐদিন ৪ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং বহু নারীর ইজ্জত হরণ ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে বহু ক্ষতি সাধন করে।১৪জন জমিদারের আবাসভূমি কলসকাঠীতে ১৪ই মে ২৮০জনকে পাশবিক অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা এবং বহু নারীর ইজ্জত হরণ করে ও কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায়, শত শত বাড়ী ঘরে অগ্নিসংযোগ করে যা ইতিহাসের এক করুণতম ঘটনা । সর্বশেষ পাক হানাদার বাহিনী আক্রমন করে শ্যামপুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে অর্থাৎ ক্যাপ্টেন নাসিরের ঘাটিতে ।১৫ই নভেম্বর বিকাল ৫ ঘটিকায় একটা যাত্রীবাহি লঞ্চে করে বরিশাল থেকে অতিরিক্ত পাক বাহিনীর দল আসে।১৬ই নভেম্বর সুভহেসাদেকের সময় পাক হানাদার বাহিনীর ধ্বনী শোনা যায়।এপর শ্যামপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় আক্রমন করা হয়।শ্যাপুরের এই আক্রমনে অনেক পাক হানাদার বাহিনী মারা যায় এবং মুক্তিযোদ্ধোদের মধ্যে ১২জন শহীদ হন ।বাকেরগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের বাহিনীর সাথে এ জেলায় সবচেয়ে ভয়াবহ চাচৈরের সন্মুখ যুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্ব ও দক্ষতার পরিচয় দেন ।এই যুদ্ধে বাকেরগঞ্জের কোন যোদ্ধাই শহীদ হন নাই তবে অনেকে আহত হয়েছেন ।৪ ডিসেম্বর সূর্য ডোবার সাথে সাথেই নাসির বাহিণী, জাফর বাহিনী এবং ওমর সাহেব আহত অবস্থায় পাদ্রীশিবপুর গীর্জায় অবস্থান করেন ।এদের নেতৃত্বে প্রায় ২/৩শ মুক্তিযোদ্ধাকে হানাদার মুক্ত করার দুর্জয় সংকল্প নিয়ে বাকেরগজ্ঞে গ্রুপ ভাগ হয়ে তিন দিক থেকে অবস্থান নেয় ।রাত ৫.৩০ মি: পজিশন নেওয়া হয়, দীর্ঘ ৫৭ ঘন্টা একটানা থেমে থেমে বিরামহীনভাবে যুদ্ধ চলে ।বাকেরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কুখ্যাত টেডা মালেক তার বাসার ছাদের উপর এক অভিনব কায়দায় বাংকার তৈরী করে সেখান থেকে বহুদূর পর্যন্ত র্দষ্টিতে দেখা যেত ।যার ফলে কোনক্রমেই এম্বুস নিয়ে আগানো সম্ভব ছিল না ।পরের দিন তিন দিক থেকে শুরু হয় সাড়াশি আক্রমণ ।পরের দিন সকালে পঞ্চল আলী মর্টার নিয়ে হাইস্কুলের নিকট, বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনে টার্গেট করে ওসির বাসার বাংকার লক্ষ্য করে আক্রমন করে ।প্রথমবারের অঘাতে বাংকারের তেমন কোন ক্ষতি হয় নাই ।২য় বার বাংকারের অর্ধেক ভেংগে যায় । ফলে কুখ্যাত শয়তানের সহোদর নরপিশাচেরা ওপর ধেকে নেমে আসার সাথে সাথে বীর মুক্তিযোদ্ধারা থানার মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং তারা আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয় ।এর ফলে আনুমানিক ৯/১০টার মধ্যে ৭ই ডিসেম্বর বাকেরগঞ্জ পাক হানাদার বাহিনীর পতন হয় এবং আকাশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয় ।বাকেরগঞ্জ হানাদার মুক্ত হওয়ার সংবাদ মুহুর্তের মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে ।প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার জনতা জমায়েত হয় ।তাদের জয়বাংলা স্লোগানে বাকেরগঞ্জ আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ।সেদিনের যুদ্ধে রাজাকার, আল বদর, আল শামস, পুলিশ, ইপিআরসহ মোট ১৭জন নিহত হয় । পুলিশ, ইপিআর, আল শামস, আল বদরসহ বহু কুখ্যাত লোক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে গ্রেফতার হয় ।বাকেরগঞ্জ মুক্ত করার যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে ২জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ।এরা হলেন মীর মোস্তফা হোসেন সিন্টু, মোহাম্মদ শাহজাহান এবং বহু মুক্তিযোদ্ধা আহত হন ।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস